এ সাইটটি মূলত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা কলামগুলোর সংকলনের সাইট। স্যারের লেখাগুলো নানা পত্রিকায় নানা সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। সাইটগুলো ক্রমাগত নানা পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে যাবার সময় লেখাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় না হারিয়ে গেলেও সেগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই সে লেখাগুলোর একটা সংকলন করার জন্যেই এ সাইটের শুরু। এ সাইটটি ফেসবুকে স্যারের ফ্যানপেজ সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর এডমিনদের উদ্যোগ। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার এই সাইট বা ফেসবুক ফ্যান পেজ কোনটির সাথেই কোনভাবে যুক্ত নন।
বাজিয়ে যাই ভাঙা রেকর্ড | মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
বেশ কয়েক বছর আগে একজন তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘আমি অমুক।’ বলাই বাহুল্য, আমি তার নাম থেকে তাকে চিনতে পারলাম না। তখন তরুণটি বলল, ‘আপনি আমার বাবাকে চিনতে পারেন। নকল করার সময় ধরে ফেলেছিলেন বলে একটা ছাত্র চাকু মেরে আমার বাবাকে খুন করে ফেলেছিল।’
সঙ্গে সঙ্গে আমি তরুণটিকে চিনতে পারলাম। তার শিক্ষক বাবার হত্যাকাণ্ডের খবরটি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। নকল ধরার জন্যে একজন শিক্ষককে খুন করে ফেলার ঘটনাটি শুধু আমার নয়, সারাদেশের সব মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। একজন ছাত্র যখন পরীক্ষায় নকল করা শেখে এবং সেটাকে তার অধিকার মনে করে, তখন সেটা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। Continue reading
বুকের ভেতর ঘৃণার আগুন |মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১৯৭১ সালের মে মাসের ৫ তারিখ বিকালবেলা পিরোজপুরের বলেশ্বরী নদীর ঘাটে পাকিস্তান মিলিটারি আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। পুলিশ প্রশাসনের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা হিসেবে শুধু আমার বাবাকেই নয়, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা হিসেবে জনাব আব্দুর রাজ্জাক এবং জনাব মীজানুর রহমানকেও একই সঙ্গে গুলি করে তাদের সবার মৃতদেহ বলেশ্বরী নদীতে ফেলে দিয়েছিল।
পিরোজপুরের নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় তাই এই তিনজন তেভাগ্য মানুষের মৃতদেহ দিনে দুইবার জোয়ারের পানিতে উত্তরে এবং ভাটার পানিতে দক্ষিণে নেমে আসছিল। তিন দিন পর আমার বাবার মৃতদেহ কাছাকাছি একটা গ্রামের নদীতীরে এসে আটকে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষরা আমার বাবাকে চিনত, তাদের মনে হলো, ‘আহা, এই মৃতদেহটি মাটি চাইছে।’ তাই তারা ধরাধরি করে আমার বাবার মৃতদেহটি তুলে নদীতীরে কবর দিয়েছিল। অন্য দুজনের সেই সৌভাগ্য (!) হয়নি এবং তাদের মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত নদীতে ভেসে হারিয়ে গিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় | মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
বছরের এই সময়টা মনে হয় দীর্ঘশ্বাসের সময়, এই সময়টিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো হয়। খুব সহজেই সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারত, কিন্তু তারপরও কিছু বাড়তি টাকা উপার্জন করার জন্য প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। বছরের এই সময়টা দেশের ছেলেমেয়েরা একেবারে দিশাহারা হয়ে দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। পরীক্ষার সময় কিছু জাল পরীক্ষার্থী ধরা পড়ে, কিছু হাইটেক নকলবাজ ধরা পড়ে। যে কয়জন ধরা পড়ে তার তুলনায় নিশ্চিতভাবেই অনেকে ধরা পড়ে না-সেটি নিয়ে খুব ব্যস্ত হওয়ারও কিছু নেই। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পরও সরকার বা কর্মকর্তারা চোখ বুজে থেকেছেন। বড় অন্যায় দেখেও যদি চোখ বুজে থাকি তাহলে কিছু ‘সৃজনশীল’ নকলবাজ যদি পুরো ভর্তি প্রক্রিয়াকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায় তাহলে সেটা নিয়ে হইচই করার কী আছে? আমরা তো রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঠিক করে নিয়েছি লেখাপড়া একটা গুরুত্বহীন বিষয়! Continue reading
প্রিয় দীপন | মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
গত কয়েকদিন থেকে আমি ছটফট করছি। সত্যিকারের কোনো কাজ করতে পারছি না। যে মানুষগুলোকে দেশের মাটিতে খুন করা হচ্ছে, জখম করা হচ্ছে, তারা আমার চেনা মানুষ, পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ মানুষ। টুটুলের ছেলে এবং মেয়ের সঙ্গে তোলা একটা ছবি আমার অফিসঘরে বহুদিন থেকে টানানো আছে। দীপন বইয়ের প্রকাশক, বই প্রকাশের কারণে বহুদিন আমার বাসায় এসেছে। তার মতো সুদর্শন, পরিশীলিত এবং মার্জিত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। দেশে আসার পর সেই ‘৯৭ সালে দীপন আমাকে তার বাবার সম্পাদিত ‘লোকায়ত’ নামে একটা সাময়িকপত্রের সংকলন উপহার দিয়েছিল। যখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম, তখন এ দেশের মানুষ কীভাবে ভাবনাচিন্তা করত আমি এই সংকলনটি থেকে জানতে পেরেছিলাম। দীপন এখন নেই। খবরের কাগজে প্রত্যেকবার তার হাসিখুশি মুখটি দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি বিশ্বাস করতে পারি না, মুক্তচিন্তার একজন মানুষের বই প্রকাশ করার জন্য কাউকে এ রকম নির্মমভাবে হত্যা করা সম্ভব। আমাদের দেশে এ রকম কিছু মানুষ গড়ে উঠেছে, আমরা সেটা সহ্য করেছি, চোখ বুজে না দেখার ভান করেছি, অস্বীকার করেছি – সেই দায় থেকে আমরা কি কখনও মুক্তি পেতে পারব? দরজা ভেঙে রক্তস্নাত সন্তানের মৃতদেহ আবিষ্কার করার হাহাকার কি এ দেশের সব বাবার হাহাকার নয়? Continue reading
ইন্টারনেটের কানাগলি | মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রায় বিশ বছর আগে আমি যখন প্রথমবার দেশে ফিরে এসেছিলাম, তখন যে বিষয়গুলো নিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলাম তার একটি ছিল, টেলিফোন। আমেরিকায় সবার বাসায় টেলিফোন এবং সেই টেলিফোন নিখুঁতভাবে কাজ করে। আমাদের দেশে টেলিফোন বলতে গেলে কোথাও নেই। আর যদিও-বা থাকে, সেগুলো কখনও ঠিকভাবে কাজ করে না। তারপরও যার বাসায় টেলিফোন আছে, তাদের অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তবে তার একটা যন্ত্রণাও আছে, আশেপাশের সব বাসা থেকে লোকজন টেলিফোন করতে চলে আসে। যারা একটু ছোটলোক ধরনের মানুষ, তারা টেলিফোনের ডায়ালের অংশটুকুতে তালা মেরে রাখত– ফোন রিসিভ করা যেত কিন্তু ফোন করা যেত না।
শুধু যে টেলিফোন ছিল না তা নয়, মনে হয় টেলিফোনের তারও ছিল না। কারণ একই টেলিফোনের তার দিয়ে একাধিক মানুষ কথা বলত এবং তার নাম ছিল ‘ক্রস কানেকশান’। প্রায়ই টেলিফোন করতে গিয়ে আবিস্কার করতাম, ইতোমধ্যে সেই টেলিফোনে অন্য কেউ কথা বলছে। তখন অনুরোধ করা হত, ‘ভাই, আপনারা টেলিফোনটা একটু রাখেন, আমরা একটু কথা বলি’। অবধারিতভাবে অন্য দুইজন বলত, ‘আপনারা রাখেন, আমরা কথা বলি’। ঝগড়া-ঝাঁটি, মান-অভিমান সবই হত। Continue reading