না, বাংলাদেশ মারা যায়নি | মুহম্মদ জাফর ইকবাল


১.

পত্রিকায় একটা খবরের শিরোনাম দেখে আমি রীতিমত চমকে উঠেছিলাম। শিরোনামটি হলো: ‘বাংলাদেশ হচ্ছে মৃতদের দেশ!’ আমার চোখ কচলে শিরোনামটি দ্বিতীয়বার পড়তে হলো। ইংরেজি শিরোনামটির বাংলায় সঠিক অনুবাদ করলে তার অর্থ হয় আরো ভয়ানক, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে মৃত চিন্তা-ভাবনার দেশ।’ আমি খুবই অবাক হলাম। এই দেশে থাকি, খাই, ঘুমাই, দেশের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করি। হঠাৎ কেমন করে দেশের সব রকম চিন্তা-ভাবনা মরে গিয়েছে জানতেই পারলাম না! আমি যখন খবরের ভেতরের অংশ পড়ার চেষ্টা করলাম তখন বুকে পানি ফিরে এলো। উক্তিটি একজন ব্রিটিশ লেখকের। লেখক তরুণ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর এরকম একটা মন্তব্য করার অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন। কারণ তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত (এরকম একটা কঠিন শব্দ লিখছি বলে ক্ষমা চাই কিন্তু আমি সঠিক শব্দটা লিখতে চাই, জিয়া হায়দার রহমান নামের এই তরুণ লেখকের পরিচয় দিতে তাঁর সম্পর্কে এই শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে)। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম, তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে হলে কী ধরনের শব্দ চয়ন করে কী ধরনের অসম্মানজনক কথা বলা একই সাথে ফ্যাশন এবং বুদ্ধিজীবীদের আচরণ হয়, সেটি আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। আমি যে ১৮ বছর দেশের বাইরে ছিলাম তখন বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেটি আমাকে আহত করেছে, বিচলিত করেছে এবং ক্রুদ্ধ করে তুলেছে, কিন্তু দেশের বাইরে থেকে আমি একটিবারও নিজ দেশের সমালোচনা করিনি। আমার মনে হয়েছে দেশের বাইরে নিশ্চিন্ত নিরাপদ আরামে থেকে দেশের সমালোচনা করার আমার কোনো অধিকার নেই! যখন দেশে ফিরে এসেছি শুধু তখনই আমার নিজের দেশের সমালোচনা করার অধিকার হয়েছে বলে মনে হয়েছে- তখন লেখালেখি করেছি, চেঁচামেচি করেছি, পথে-ঘাটে বসে থেকেছি, আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। (এখন এই দেশে আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, সেরকম মানুষের সংখ্যা যে কোনো হিসেবে ঈর্ষণীয়!) কিন্তু একজন মানুষ যদি বাংলাদেশি না হয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হয় এবং মানুষটি যদি লেখালেখির জগতে খুব অল্প বয়সে অনেক সুনাম অর্জন করে থাকেন তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার মন্তব্য সবাইকে হজম করতে হবে। খবরের কাগজে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী এবং বড় বড় অধ্যাপকেরা সেটা বেশ ভালোভাবে হজম করেছেন।

‘বাংলাদেশ হচ্ছে মৃত চিন্তা-ভাবনার দেশ’- এই শিরোনামের খবরের ভেতরের অংশ আমি পড়িনি। কান এবং চোখের মাঝে একটা খুবই মৌলিক পার্থক্য আছে, কানের কোনো পাতি নেই তাই কানের কাছে কেউ কিছু বললে সেটা না চাইলেও শুনতে হয়। চোখের পাতি থাকে তাই আমি যদি কিছু দেখতে না চাই চোখের পাতি ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারি। তাই জিয়া হায়দার রহমান নামের অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং বিখ্যাত সেই তরুণ লেখকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই বক্তব্যটি আমি পড়ে দেখা প্রয়োজন মনে করিনি, চোখ বন্ধ করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেলেছি এবং কিছুক্ষণের মাঝে পুরো বিষয়টি ভুলে গেছি। কিন্তু ডিসেম্বরের ৯ তারিখ প্রথম আলোতে শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা একটা প্রবন্ধ ‘চিন্তা-চেতনায় মৃত বা বন্ধ্যা ভূখণ্ড’ দেখে আমি আবার চমকে উঠলাম- একই ধরনের শিরোনাম এবং এবারে লেখক কোনো বিদেশি নন, লেখক আমাদের বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী। আমি লেখাটি পড়ে দ্বিতীয়বার চমকে উঠলাম কারণ এই লেখাটিতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে বিখ্যাত এবং তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান যেটা বলেছেন সেটা সত্যি- আসলেই আমাদের দেশের চিন্তা-ভাবনা মরে গেছে, বাংলাদেশ চিন্তা-ভাবনার জন্ম দিতে অক্ষম একটি মৃত ভূখণ্ড! আমি যাদের সাথে সময় কাটাই তারা প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা করে, এখন তাহলে কী আমার তাদেরকে বলতে হবে তোমাদের চিন্তা-ভাবনা মৃত? তোমরা বন্ধ্যা দেশের নিষ্ফল কারিগর? তোমরা এই দেশ পরিত্যাগ করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করো, সেইসব দেশে গিয়ে হোটেলে বাসন ধোয়ার ফাঁকে-ফাঁকে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করো, কারণ এই দেশে বুদ্ধিবৃত্তির কোনো স্থান নেই? চিন্তা-ভাবনার কোনো অস্তিত্ব নেই?

আমার মনে হলো আমার আশে-পাশে যারা থাকে তাদেরকে এতো কঠিন একটা কথা বলার আগে আমার সম্ভবত বিষয়টা আরেকটু তলিয়ে দেখা দরকার। তখন আমাকে পুরনো পত্রিকা ডিসেম্বর ২০১৪ ডেইলি স্টার খুঁজে বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমানের আসল বক্তব্যগুলো পড়তে হলো। প্রথমে আমি ছোট একটা ধাক্কা খেলাম, তিনি বলেছেন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছেন দু’জন মহিলা। নিজেদের যোগ্যতায় নয়, মৃত ব্যক্তিদের ছায়ায়! (যে দেশের রাজা-রাণী, রাজপুত্র, রাজকন্যা থাকে সেই দেশের মানুষ যখন এরকম কথা বলেন তখন আমি কৌতুক অনুভব করি- যাই হোক সেটা ভিন্ন কথা) তবে ‘দুই মহিলা’ কিংবা ‘দুই বেগম’-এর তত্ত্ব অবশ্যি মৌলিক কথা নয়, পশ্চিমা দেশের পত্র-পত্রিকা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে এভাবে ব্যাখ্যা করে এবং পশ্চিমা পত্র-পত্রিকা পড়তে অভ্যস্ত মানুষ কিংবা বুদ্ধিজীবীরাও এই ভাষায় কথা বলতে আরাম বোধ করে। তারা নিশ্চয়ই ভাবেন, এতো বড় নামি-দামি পত্রিকা যেহেতু এই ভাষায় লিখে সেটা তো নিশ্চয়ই ভুল হতে পারে না!

যাই হোক আমি বিষয়টা একটু অন্যভাবে দেখানোর চেষ্টা করি। ধরা যাক, শেখ হাসিনার নাম শেখ হাসান- অর্থাৎ তিনি মহিলা নন পুরুষ, বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন, বঙ্গবন্ধুর পুত্রসন্তান। এবং ধরা যাক, খালেদা জিয়ার নাম খালেদ রহমান, অর্থাৎ তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী নন, জিয়াউর রহমানের ভাই কিংবা অন্য কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত একজন পুরুষ মানুষ। ধরা যাক, এই দু’জন পুরুষ মানুষই একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ধরা যাক, শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া যেভাবে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন শেখ হাসান এবং খালেদ রহমান নামে এই দু’জন কাল্পনিক পুরুষ প্রধানমন্ত্রী হুবহু একইভাবে কথাবার্তা বলেন। তাহলে কী ইকোনমিস্ট নামের বিখ্যাত পত্রিকা তাদের আচার-আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্যে ‘দুই পুরুষের’ কর্মকাণ্ড এরকম শব্দ ব্যবহার করতো? বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান এই দু’জন মানুষকে বোঝানোর জন্যে ‘দুই পুরুষ’ শব্দটা ব্যবহার করতেন? কিংবা শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদই কী তাদের দু’জনকে ‘দুই পুরুষ’ বলতেন? আমি লাখ টাকা বাজি ধরে বলতে পারি তারা এই দু’জনকে তখন ‘দুই পুরুষ’ কিংবা ‘দুই সাহেব’ বলতেন না। দুই ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলতেন।

কিন্তু শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে বোঝানোর জন্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সবাই ‘দুই মহিলা’ বা ‘দুই বেগম’ শব্দ ব্যবহার করেন। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, তাদের প্রধানমন্ত্রিত্ব কিছুই কারো চোখে পড়ে না- তাদের চোখে পড়ে যে তারা দু’জন মহিলা!

একাত্তরে আমার বাবা মারা যাবার পর আমার সাদাসিধে মা যদি আমাদের দায়িত্ব না নিতেন আমরা কোথায় ভেসে যেতাম জানি না। বিয়ে করার পর আমি প্রথমবার একজন মহিলাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং মহিলাদের কী ধরনের শক্তি কিংবা সাহস থাকে টের পেয়েছি। কর্মজীবনে মহিলাদের সাথে কাজ করেছি এবং এখন অসংখ্য ছাত্রী এবং সহকর্মীদের দেখে মুগ্ধ হয়েছি! আমি খুব ভালো করে জানি টিটকারী করার জন্যে মহিলা শব্দটা আবিষ্কার করা হয়নি। তাই যখন কাউকে (কিংবা কোনো বিখ্যাত সংবাদপত্রকে) দেখি একজন মানুষের হাজারটা পরিচয়ের মাঝে তার ‘মহিলা’ পরিচয়টাকেই খারাপ কিছুকে প্রকাশ করার জন্যে ব্যবহার করা হয়, তখন আমার মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপটা আমি নিজের ভেতরেই রাখি কিন্তু যখন দেখি শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের মতো মানুষেরাও একই কথা বলেন তখন আমি এক ধরনের বেদনা অনুভব করি। আমার মনে হয় মেয়েদেরকে জানানো উচিত সবাই এভাবে ভাবে না- অনেকেই তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে প্রস্তুত।

২.
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাই সোজাসুজি কথা বললে সেটা বোঝা আমার জন্যে সহজ হয়। সংখ্যা দিয়ে কিংবা উদাহরণ দিয়ে কিছু বলা হলে সেটা ধরতে পারি, ঢালাওভাবে কিছু বলা হলে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান এবং শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা পড়েও আমি একটু বিভ্রান্ত হয়েছি; কারণ দু’জনেই পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বিন্দুমাত্র আলো দেখতে পাচ্ছেন না! (লেখার এই অংশটুকু আমাকে কয়েকবার পড়তে হয়েছে। কোনো মানুষের পক্ষে এতো নিশ্চিতভাবে একটা দেশ সম্পর্কে এরকম একটা ভয়ংকর কথা বলা সত্যিই সম্ভব, সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয়নি।) আমাদের দেশ সম্পর্কে এরকম একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন হেনরী কিসিঞ্জার, যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রচেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেলো, তখন হেনরী কিসিঞ্জার আমাদের দেশকে ভবিষ্যতের একটি তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে খুব সমীহ করে চলে এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেকবার বলেছেন, সামাজিক সূচকের অনেকদিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে অনেক এগিয়ে আছে! হেনরী কিসিঞ্জার এখন কী এই কথাগুলো জানেন?

যা’হোক একটি দেশের ভবিষ্যতে ‘বিন্দুমাত্র আলো নেই’ এটি একটি অত্যন্ত কঠিন কথা। আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি, বাংলাদেশের হৃদস্পন্দন শুনি, তারা জানি, এটি কিছুতেই সত্যি হতে পারে না! এই দেশের সমস্যার কোনো শেষ নেই- কিন্তু এ কথাটি পুরোপুরি সত্যি যে, কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক বাংলাদেশ আসলে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে!

৩.
বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের সামনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে চিন্তা-ভাবনায় মৃত একটি দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা কোনো শিক্ষক সেটার প্রতিবাদ করে কিছু বলেছেন সেটা চোখে পড়েনি। বরং শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদ সেই ছোট ঘোষণার পক্ষে অনেক বড় একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুলে ‘ব্যাখ্যা কর’ বলে গভীর জ্ঞানের একটা লাইন লিখে দেয়া হতো। আমরা শুরু করতাম এভাবে, ‘আলোচ্য অংশটি অমুক লেখকের অমুক লেখা থেকে নেয়া হয়েছে।’ তারপর সেই একটি লাইনকে অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে লিখতাম। শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের লেখাটি পড়ে আমার হুবহু সেই কথাটি মনে হয়েছে। লেখাটি দেখে মনে হয় কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমানের দুই তিনটি লাইনকে অনেক বড় করে ব্যাখ্যা করার জন্যে, এবং তিনি সত্যিকারের ভালো ছাত্রের মত সেটাকে ব্যাখ্যা করেছেন। একজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী এভাবে একটা ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে অনেক তরুণ কমবয়সী ছেলে-মেয়ে সত্যি সত্যি সেটা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে, তারা মনে করতে পারে সত্যিই বুঝি বাংলাদেশে চিন্তা-ভাবনার জন্ম হয় না, সত্যি বুঝি বাংলাদেশ চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে মৃত এবং একটি বন্ধ্যা ভূখণ্ড। কাজেই আমার মনে হয়েছে আমি নিজে এ ব্যাপারে কী ভাবি সেটা একটু বলা দরকার।

আমি আঠারো বছর পাশ্চাত্য দেশে কাটিয়ে এসেছি, আমার নিজের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঐ দেশগুলোতে আমার চিন্তা-চেতনা বিকাশের যেটুকু সুযোগ ছিল আমার নিজের দেশে সুযোগ তার থেকে অনেক বেশি। এই দেশে অসংখ্য মানুষ নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাজ করছে, আমি শুধু আমার একান্ত নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার একটা তালিকা দেই। প্রায় একযুগ আগে আমরা কয়েকজন ভাবছিলাম, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা যেন আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যেতে পারে সেরকম একটা ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? আমাদের সাথে যে তরুণ ছেলেমেয়েরা কাজ করেছে তারা গণিত অলিম্পিয়াডকে গণিত উৎসবে পরিণত করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে ক্লাস থ্রী’র বাচ্চাদের নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড হয় না- আমাদের দেশে হয় এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কাজ করি। কয়েক বছর আগে তাদেরকে বলেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি রেজিস্ট্রেশনের যন্ত্রণা কমানোর জন্যে মোবাইল টেলিফোনে এসএমএস করে পুরো প্রক্রিয়াটি কী শেষ করা সম্ভব? আমার বাচ্চা সহকর্মীরা এই দেশের মানুষের জন্যে মোবাইলে ভর্তি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে। এটি মৃত আইডিয়া নয়- বাংলাদেশের প্রায় সব স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এই প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়। আমার সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা কাজ করে- আমি যখন তাদেরকে বলি যে, ‘এরপর আমরা একটা ড্রোন বানাবো’ তারা আমাকে ড্রোন বানিয়ে দেয়, যখন বলি ‘একটা রকেট বানালে কেমন হয়’ তারা রকেট বানিয়ে দেয়, যখন বলি, ‘পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি’ তারা পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে এপস বানিয়ে দেয়, যখন বলি ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্যে সহজ ব্রেইল কী তৈরি করা সম্ভব?’ তারা দ্রুত তার একটি সমাধান বের করে আনে। যখন বলি, ‘পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকে ঠেকাতে হবে’, দেশের নানা ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা একশ’টা আইডিয়া নিয়ে পথে নেমে আসে। আমি যাদেরকে নিয়ে সময় কাটাই তারা আমাকে নতুন নতুন কী আইডিয়া দিয়েছে আমি সারাদিন ধরে বলে সেটা শেষ করতে পারব না! যদি এই দেশের অন্যান্য মানুষের অভিজ্ঞতার কথা বলি তাহলে সেটি কী বলে শেষ করা সম্ভব? কয়েকটা উদাহরণ কী দেব?

গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে আছে? একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়টি যথাযথ হয়নি বলে এই দেশের তরুণ সমাজ সম্মিলিতভাবে পথে নেমে আসে, সারা দেশ নয়- সারা পৃথিবীতে কী রকম আন্দোলন গড়ে তুলেছিল- তার কথা মনে আছে? সেটি কী চিন্তা-ভাবনার জগতের একটি বিপ্লব ছিল না? পৃথিবীর বেশির-ভাগ দেশ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার জন্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়। আমাদের দেশে নিজেদের ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেছি, সেটি কী সারা পৃথিবীর জন্যে ভবিষ্যতের একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে না? প্রফেসর ইউনূস তার নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে পৃথিবীকে চমৎকৃত করছেন না? তার চিন্তার ক্ষেত্রটি তো বাইরের কোনো দেশ নয়- আমাদের বাংলাদেশ। ঠিক সেরকম স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার বিশাল প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের নানা কর্মকাণ্ড দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিচ্ছেন না? সেটি কী গতানুগতিক কাজ, না কী নতুন চিন্তা-ভাবনার বাস্তবায়ন? দেশের অসংখ্য এনজিও নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছে, কতো বিচিত্র তাদের আইডিয়া, কতো আন্তরিক তাদের কাজকর্ম? সেগুলো একটাও কী চিন্তা-ভাবনার জগতের একটা অবদান হিসেবে বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান বা শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের চোখে পড়তে পারে না?

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের নানা অভিযোগ- কিন্তু দেশের তিন কোটি ছেলেমেয়ের হাতে বছরের প্রথম দিনে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়ার পরিকল্পনাটা কী নতুন আইডিয়া নয়? নানা রকম চেষ্টা-চরিত্র করে দেশের মেয়েদের, দেশের ছেলেদের সাথে সমান হারে লেখাপড়া করানো কী চিন্তা-ভাবনার জগতের একটা অবদান মনে করা যায় না? বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী পৃথিবীর নানা দেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে কাজ করে। সেরকম অনেক দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তা তৈরি হয়েছে এমনকী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছে- সেগুলো কী একটা বন্ধ্যা দেশের পরিচয়?

পৃথিবীর কয়টা দেশ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের গড়ে তোলা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মতো একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিয়ে অহংকার করতে পারবে? আর কতো উদাহরণ দেব?

আমি একবারও বলিনি এই দেশের কোনো সমস্যা নেই- এই দেশে অসংখ্য সমস্যা আছে। অসংখ্য অবিচার-অনাচার, দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আছে। দেশের অনেক কিছু নিয়ে আমাদের তীব্র ক্ষোভ আছে। অনেক জগদ্দল পাথর আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে, আমরা ঠেলে সরাতে পারি না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের দেশ চিন্তা-চেতনায় মৃত একটি দেশ, আমরা একটি নিষ্ফলা বন্ধ্যা দেশ!

একজন মানুষ তার স্বপ্নের মতো বড়। একাত্তরের বাস্তবতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু এই দেশের মানুষ সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে অচিন্তনীয় আত্মত্যাগ করতে রাজি ছিল বলে আমরা একটা দেশ পেয়েছি। আমার মতো ক্ষুদ্র একজন মানুষ এই দীর্ঘ জীবনে যতবার যা কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি কেন তাহলে সেই সত্যটি উচ্চকণ্ঠে সবাইকে শোনাব না?

যাদের সেই স্বপ্ন দেখার শক্তি, সাহস বা ক্ষমতা নেই তারা যদি অন্যদেরকেও স্বপ্ন দেখতে দিতে না চান কেন তাহলে আমি প্রতিবাদ করব না?

5 thoughts on “না, বাংলাদেশ মারা যায়নি | মুহম্মদ জাফর ইকবাল

  1. বেশ কিছুদিন আগে একটি অর্গানাইজেশনের assessment এ থাকার সুযোগ হয়েছিলো। Evaluation Team এ নাম করা প্রভাবশালী বিদেশী ব্যাক্তিবর্গের সাথে আমাদের সরকারী পর্যায়ের একজন বয়স্ক আমলাও ছিলেন। কথা হচ্ছিলো আমাদের দেশের কর্মীদের পাশাপাশি বিদেশী expert দের আসা কতটুকু জরুরী।

    বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামতের মধ্যে একজন বললো যে আমরা বাঙ্গালীরা নাকি কখনই বিদেশীদের মত SKILLED হতে পারবো না, তাই experts লাগবে।

    তার এই কথায় Evacuation Team এর যে স্বল্প ও মিষ্ঠভাষীট সদস্যটি ছিলেন, তিনি হঠাৎ করে রেগে গেলেন এবং চিৎকার করে কথা বলতে শুরূ করলেন। তিনি বলতে লাগলেন সেই অর্গানাইজেশনের এতদিনের সাফল্যের পিছনে বাঙ্গালাদেশীদের অবদানের কথা। তিনি কথা বলতেই থাকলেন এবং আর কোনো সদস্যকেই কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিলেন না।

    এক পর্যায়ে একজন বিদেশী সদস্য ওনাকে থামতে চেস্টা করলে তিনি তার দিকে ফিরে বলেন, আপনি আমাকে থামাচ্ছেন কেনো, আপনি কি চেয়ারপার্সন নাকি, আপনি যেমন একজন বিচারক, আমিও এখানে একজন বিচারক, আপনার কোনো অধিকার নাই আমাকে থামাবার, আমাকে আপনি থামাবেন না, আমি আগে শেষ করি, তারপর বলবেন….এসকল কথা বলতে বলতে তিনি রীতিমতো উত্তেজনায় বা রাগে কাঁপছিলেন। মনেহচ্ছিলো, এই বিদেশীদের সামনে নিজের দেশের এই অপমান কিছুতেই উনি মেনে নিতে পারছিলেন না আর সেটা মিথ্যা প্রমান করতে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।

    বিদেশী ভদ্রলোকটি, যিনি বেশ প্রভাবশালী, নার্ভাস হয়ে অপ্রস্তুতভাবে চুপ করে গেলেন।

    সারা রুমে তখন পিনপতন নিঃস্তবদ্ধতা আর আমি তখন উত্তেজনায় কাঁপছি – YES YES YES!!!!!! এই না হলে দেশপ্রেম!!!!.সাবাশ এই ছোটোখাটো মানুষটিকে!!! আমাদের জাতীয় পর্যায়ে এইরকম মানুষগুলো এখনো তাহলে আছে!!! চিৎকার করে নিঃস্তবতা ভেঙ্গে বলতে ইচ্ছা করছিলো, স্যার আপনি তো যোশ!!!! …
    ………………………………
    শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারকে বলছি – “স্যার, আমাদের দেশে ঐ বাঙ্গালী ছেলেটি, যে কিনা কখনোই বাঙ্গালী হিসেবে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে নাই, তারা যেমন আছে, তেমনি ঐ সরকারী আমলা ভদ্রলোকের মতোও কিছু ছায়া আমাদের মাথার উপরে আছেন, যেমন আছেন আপনি। আমরা পথ হারাবো না স্যার। ত্রিশলক্ষ্য শহীদ আর ৪ লক্ষ্য বীরাঙ্গনাদের জন্যই আমাদের জিততে হবে….
    ——————————–
    অনেকের লেখা পড়ি, অনেককে অনেক রকম করে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু স্যারের প্রতিটি কথাই মনেহয় যে একদম মনের কথা। আমার সাধারনত কাউর সাথেই মনের মিল হয় না, তাই সকলে আমাকে খুব কঠিন এবং অঅহংকারী বলে। কিন্তু স্যারের সাথে তাহলে কেনো সব চিন্তাভাবনা মিলে যায়????? কি যে অদ্ভুত এক মানুষ….
    ———————————
    স্যার, আমার কথা বলছি। ছোটো বেলা থেকে দেশের বাইরে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম, কারন নারী হিসাবে সেখানে কিছুটা স্বাধীনচেতা হয়ে বাঁচা যায় – এই চিন্তায়। কিন্তু এখন কেমন যেনো এই সিদ্ধান্তটাকে অদ্ভুত লাগে। এদেশের বাইরে স্যাটেল করার বেশ কিছু সুবর্ন সুযোগ জীবনে অনেকবারই হয়েছিলো। ইচ্ছে করলেই কোনো একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ পর্যায়ে ডিগ্রী লাভের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে এটাকে কোনো option বলেই মনেহয় না। তাই, যখনই এরকম কোনো সুযোগ এসেছে, সিদ্ধান্ত নিতে স্বপনেও এক মুহুর্ত দ্বিধা করিনি..মনেহয়, ওমা, বাংলাদেশকে ছেড়ে চলে যাবো??? এটা কক্ষনো হয় নাকি??? আর একথা বলতে বলতে আমি প্রতিবারই কেঁদে ফেলি।

    কিযে মায়া লাগে স্যার দেশটার জন্য সেটা বোঝাতেই পারবো না। এই যে এই লাইনটি লিখছি, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। এই যে সুখে দুঃখে এই অভাগা দেশটির মধ্যে সকলে একসাথে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছি, এই আনন্দের চেয়ে জীবনে যে আর কিছুই হতে পারেনা সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে বুঝবে স্যার…..????!!!!

    Like

    • আপনার এই আবেগটুকু অনেক বড় সম্পদ, এই আবেগটার প্রতি শ্রদ্ধা রইল।

      Like

  2. দেশদ্রোহীতা এবং দেশ ও দেশের মানুষকে অপমান করে বলা কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের রেকর্ড ঐ ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্টের ইলেকট্রনিক চিপসে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়তো একদিন চালু হবে।

    Like

  3. @Rasheda khan,
    Let’s not sacrifice sophistication for the shake of passion.
    Show of anger or overpowered by emotion is a humane thing but also signs of immaturity and primitivism.
    good communication skill is the key to get the message across.

    Like

Leave a comment